
ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত
মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্ম গ্রহণ করলেও পদে পদে শৃঙ্খলার শিকলে বন্দী মানুষের জীবন। অসীম চাওয়ার রাজ্যে মানুষের পাওয়াগুলো নিতান্তই আপেক্ষিক। চাওয়া-পাওয়ার চোরা বালিতে মরীচিকাময় স্বপ্নে বিভোর মানুষগুলোর আকাক্সক্ষার যেন শেষ নেই। এ হিসেব এতটাই নির্মম ও নিষ্ঠুর যার নির্মমতায় আপন-পর ঠাহর করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। তৈরি হয় অবিশ^াস, ভেঙ্গে পড়ে সংসার, ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়ে বন্ধন, ভূলুণ্ঠিত হয় মানবতা। অতৃপ্ত আত্মা এতোটাই বেসামাল হয়ে পড়ে যে, মিথ্যে তৃপ্তির আস্বাদন লাভে ন্যূনতম সামাজিকতা দেখানোর প্রয়োজনও বোধ করে না। কিন্তু সামাজিক বন্ধনের দৃঢ়তার উপরই নির্ভর করে আত্মার প্রশান্তি, বিষয়টি বেমালুম ভুলে যায়। অদৃশ্য এ বন্ধন নির্মাণে তাই প্রয়োজন হয় গুরুর দীক্ষা, আবির্ভূত হয় শিষ্য। এই বন্ধনকে জন্মগুরু, শিক্ষাগুরু, কর্মগুরু ও আধ্যাত্মিগুরু পর্বে পরিবীক্ষণ করা যায়। মূলত এই পৃথিবী একটি শিক্ষাক্ষেত্র, যেখানে শিখন-শেখানোর আবর্তে আবর্তিত হয় মানুষের জীবন। যদি বন্ধন সুদৃঢ় হয় তাহলে শিক্ষা হয় স্বত:স্ফূর্ত ও প্রাণবন্ত, অন্যথায় তা অকর্ষিত ও মূঢ় হয়ে পড়ে। বিশ্ব জোড়া পাঠশালা সাদৃশ্য শিক্ষার এ ভুবনে গুরু-শিষ্য বলতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বুঝানো হলেও এর অর্থ ব্যাপক। জোয়েল স্লেকো বলেছেন, ”গু মানে অজ্ঞতা আর রু মানে বিতরণকারী”, গুরু মানে সেই ব্যক্তি যিনি ” সকল প্রকার অজ্ঞতা দূর করেন”। ক্যারেন পেচেলিস এঁর মতে- ” অন্ধকার দূরকারী, যিনি পথ নির্দেশ করেন” তিনিই গুরু। অন্যদিকে যিনি শূন্য মস্তিষ্কে গুরুর নিকট ভক্তি, শ্রদ্ধা ও বিশ্ব।সের সাথে জ্ঞান লাভ করেন এবং গুরুর আজ্ঞা পালন করেন তিনিই শিষ্য।
জন্মগুরু পর্ব। এই পর্বে মা-বাবা একদিকে জন্মদাতা অন্যদিকে আবার শিক্ষক হিসেবে শিক্ষাগুরুর ভূমিকাও পালন করে থাকেন। সেক্ষেত্রে বাবা-মা-ই শিশুর বুনিয়াদি শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হন। তাই বাবা-মাকে এ সময় যথেষ্ট যত্নবান ও মনোযোগী হতে হয় শিশুর প্রতি। শৈশবকালে বাবা-মার সামান্যতম অনিহা বা অযত্ন শিশুর চলার ছান্দিক স্বকীয়তা ও শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত করতে পারে। মাতাপিতার যেমন সন্তানের উপর দায়িত¦ ও কর্তব্য রয়েছে, সন্তানকেও তেমনি মা-বাবার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রচেষ্টায় মনোযোগী থাকতে হবে সর্বান্তকরণে। মহান এ দায়িত্ব যথাযথ পালনের মাধ্যমেই তৈরি হতে পারে আত্মিক বন্ধন, যা এনে দিতে পারে আত্মার পরম সুখ। সন্তানকে এ বিষয়টি সমগ্র জীবনের বিনিময়ে উপলদ্ধি করে তার যথাযথ মূল্যায়ণ নিশ্চিত করতে হবে, অন্যথায় জীবনের প্রকৃত নির্যাস আস্বাদন সম্ভব নয়। শূন্য হতে শুরু হয়ে পর্যায়টি ছয় বছর, কোন কোন ক্ষেত্রে তা আরও বর্ধিত হতে পারে, কিন্তু বন্ধন টিকে থাকে আমরণ। সন্তান জন্ম দিয়েই জন্মদাতা আর শিশু হিসেবে জন্ম নিয়েই সন্তান হওয়া যায়, কিন্তু গুরু-শিষ্য পর্যায়ের জন্মদাতা ও সন্তান হতে থাকা চাই অনেক অর্জন। পবিত্র সম্পর্ক, শ্রদ্ধাবোধ, কর্তব্যবোধ ও আনুগত্যের উপর-ই নির্মিত হয় এ পর্বের সাফল্যের বন্ধন।
শিক্ষাগুরু পর্ব। কৈশোর ও বয়:সন্ধিকাল পেরিয়ে মানব শিশু এ পর্বে এসে যৌবনে পদার্পণ করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষককেই মূল ভূমিকায় অবতীর্র্ণ হতে হয়। শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সুযোগ তৈরি করে দেয়। শিক্ষাই মানুষকে জৈবিকতার নীচের ঘর থেকে মনুষ্য লোকের উপরের ঘরে পৌঁছে দেয়। এখানে এসেই মানুষ বুঝতে শেখে অর্থ সাধনার চেয়ে জীবন সাধনা বড় এবং জীবন সাধনায় মুক্তি। শুধু অর্থ আর শক্তিই নয়; নিষ্ঠা, সততা, ন্যায়বোধ, দেশাত্মবোধ, সহমর্মিতা, সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ মানব কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এই পর্বে এসে শিক্ষক একদিকে শিক্ষাগুরু ও অন্যদিকে জন্মগুরুর ভূমিকাও পালন করে থাকেন। এই জন্য একজন সুশিক্ষক কখনও শিক্ষক, কখনও পিতা, কখনও অভিভাবক, আবার কখনো বা বন্ধু। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে তাই থাকতে হবে এক অদৃশ্য পবিত্র সুসম্পর্ক, ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য। শিক্ষক যেভাবে তাঁর শিক্ষার্থীকে সত্য ও আলোর সন্ধান দেন, একজন শিক্ষার্থীকেও সারা জীবন দিয়ে সেই আলোর মূল্য খুঁজে বেড়াতে হবে সবকিছুর ঊর্দ্ধে। এ পর্যায়টি ছয় বছর হতে শুরু হয়ে চব্বিশ বছর বা কোন কোন ক্ষেত্রে তা কম-বেশি হতে পারে। শিক্ষা দিলেই শিক্ষক আর শিক্ষা নিয়েই শিক্ষার্থী হওয়া যতটা সহজ, গুরু-শিষ্য স্তরের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী হওয়া ততটা-ই কঠিন। এর জন্য থাকা চাই মঙ্গলবোধ, শ্রেয়বোধ ও মনুষ্যত্ববোধের মতো মহত্ গুণের সন্নিবেশ।
কর্মগুরু পর্ব। কর্ম জীবন মানুষের এক বিষ্ময়কর আর অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কারণ এ ক্ষেত্রে গুরুর কোন নির্দিষ্টতা থাকেনা। কর্ম জীবনে এসে মানুষ তাঁর সমগ্র জীবনের এক বৃহৎ অংশ অতিবাহিত করে কর্মক্ষেত্রে, তাই কর্মক্ষেত্রের প্রশান্তি জীবনের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। শিক্ষাজীবন শেষ করে মানুষ যখন কর্ম জীবনে প্রবেশ করে, অনেক কিছুই তার কাছে অপরিচিত মনে হয়। সে সময়ের সমস্যা সংকুল সমুদ্র পাড়ি দিতে বস বা মনিবের দীক্ষা অতি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মানুষ তার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে অর্জিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এখানে কাজে লাগাতে পারে কর্তৃপক্ষ বা মনিবের সহযোগিতায়, যেখানে প্রয়োজন হয় আন্তরিকতা, আস্থা ও বিশ^াস। পিতামাতা ও শিক্ষক যেমন জীবনকে আলোকিত করেন তদ্রুপ কর্মগুরু তাঁর কর্ম কৌশলের উষ্ণ পরশ বুলিয়ে সেই আলোকে কাজে পরিণত করতে সাহায্য করেন। তাই গুরু ও শিষ্য উভয়কেই পদ-পদবির ঊর্দ্ধে নিজেকে মানুষ ভাবতে হবে। পঁচিশ বছর হতে শুরু হয়ে ষাট বছর পর্যন্ত এ পর্যায় চলতে থাকে, কারণ ষাটের পর মানুষ নতুন করে আর কিছু শিখতে চায় না! এ ক্ষেত্রে কর্মদাতা ও কর্মী বনে যাওয়া যতটা সহজ, কর্মগুরু ও যোগ্য শিষ্য হওয়া ততটাই দুরূহ; এ জন্য প্রয়োজন হয় নির্লোভ সম্পর্ক, দক্ষতা, নিষ্ঠা, বিশ^াস ও দেশপ্রেম।
আধ্যাত্মিকগুরু পর্ব। এ পর্যায়ে এসে মানুষ সত্যানুসন্ধানে সত্যের সাধনায় চিন্তার জগতকে আন্দোলিত করে ও সত্য আবিষ্কারকে সম্ভব করে তোলে। প্রমথ চৌধুরীর মতে- ’যিনি যথার্থ গুরু তিনি শিষ্যের আত্মাকে উদ্বেলিত করেন এবং তার অন্তর্নিহিত সকল প্রচ্ছন্ন শক্তিকে ব্যক্ত করে তোলেন। সেই শক্তি বলে শিষ্য নিজের মন নিজে গড়ে তোলে’। এ পর্বে মানুষের বয়স্কতা থেকে বার্ধক্য গণনা শুরু হয়। এ সময় মানুষ কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা যাঁকে দেখলে বা যাঁর কর্ম-কাণ্ড ও আচার-আচরণে সৃষ্টিকর্তার স্মরণ এবং ইবাদতের প্রতি আগ্রহ জন্মে এমন ব্যক্তির সান্নিধ্যে দীক্ষা নিয়ে থাকে। আধ্যাত্মিক গুরুর পর্বটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং নির্বাচন সাপেক্ষ। তাই এক্ষেত্রে মানুষকে যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হয়, গুরু নির্বাচনের সঠিকতা যাচাইয়ে। যদিও এ পর্বটি মানুষের আগের পর্বগুলোরই ধারাবাহিকতা বৈকি!
মানুষ তার সমগ্র জীবনে মূলত এই চারটি পর্যায় অতিক্রম করে থাকে। কোন একটি পর্বের উন্নয়নের উপর জীবনের পরিপূর্ণ সফলতা বিবেচন করা যায় না। কারণ সাফল্যের জন্য দুটি বিষয়ের মুক্তি প্রয়োজন একটি হলো অর্থনৈতিক মুক্তি আর অন্যটি আত্মিক মুক্তি। বর্ণিত চারটি পর্বের সম্পর্কের উন্নয়নের মাধ্যমে আস্থা ও বিশ^াস অর্জনই সাফল্যের মূলমন্ত্র। প্রতিটি মানুষ সুখ চায়, শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায় কিন্ত এ তিনটি বিষয়ই আপেক্ষিক। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মতে, ’’অর্থ চিন্তার নিগঢ়ে সকলে বন্দী। ধনী, গরিব সকলেরই অন্তরে সেই একই ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে; চাই, চাই আরও চাই’’। এখান থেকে বাঁচার উপায় কী? মানুষ শুধু অর্থনৈতিক মানুষ নয়, বস্তুর বাইরে আরও জগৎ আছে। ইন্দ্রিয়ের সুখ ছাড়াও আত্মার ক্ষুধা আছে; আত্মার স্বাধীনতাই আত্মার ক্ষুধা মেটাতে পারে। প্রমথ চৌধুরীর মতে,”একথা আমরা সবাই জানি যে, উদরের দাবি রক্ষা না করলে মানুষের দেহ বাঁচেনা, কিন্ত এ কথাও সকলেই জানি যে, মনের দাবি রক্ষা না করলে মানুষের আত্মা বাঁচেনা”। এ বোধ থেকেই মনুষ্যত্বের উদয় হয়। আর এ পথটিই গুরুর নির্দেশিত পথ। আত্মার নিবৃত্ত ক্ষুধার মধ্যেই রয়েছে পরম সুখ। আত্মার ক্ষুধা মেটানোর জন্য প্রয়োজন তাই গুরুর সান্নিধ্য, আর এর মাঝেই নিহিত রয়েছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি।
লেখক:
ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত
শিক্ষা কর্মী
মাউশি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়