অর্থনীতিবিদদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ!

করোনার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নানামুখী প্রভাব পড়েছে গোটা বিশ্বে। অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে ধনী রাষ্ট্রও। এমন অবস্থায় বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ার আশঙ্কার কথা বলছে খোদ জাতিসংঘের সংস্থা ‘ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (ফাও)। এতে বাংলাদেশসহ ৪৫টি দেশ খাদ্য সংকটে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ টেনে প্রতিনিয়ত সবাইকে সঞ্চয়ের পরামর্শ দিচ্ছেন। খাদ্য সংকট এড়াতে প্রতি ইঞ্চি ফাঁকা জমিতে কৃষি উৎপাদনেও তাগিদ দিচ্ছেন। এমনকি সরকারের তরফে বারবার দুর্ভিক্ষের কথা বলার যৌক্তিকতা দেখছেন দেশের অর্থনীতিবিদরাও। তারাও বলছেন এমন আশঙ্কার কথা। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাদের আছে নানা পরামর্শও। বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দরিদ্রদের খাদ্য সহায়তা দিতে পারলে খাদ্য সংকট হলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এদিকে, বিশ্ব খাদ্য সংস্থার শঙ্কা প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যখন দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তখন রাজনৈতিক অঙ্গনেও এ নিয়ে চলছে আলোচনা। বিএনপি নেতাদের প্রশ্ন- সরকার নিজেদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি করলেও এখন খাদ্যসংকট নিয়ে কেন এত চিন্তিত?

অর্থনীতিতে নানামুখী সংকট

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মূল্যায়নে উঠে এসেছে- সামগ্রিকভাবে বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সাতটি সংকট বিরাজ করছে। এরমধ্যে রয়েছে- ডলার সংকট, জ্বালানির উচ্চমূল্য, অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ ও করোনা পরিস্থিতি। এমন সংকট মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।

সিপিডি বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ইতোমধ্যে দেশের মানুষ খাবার কমিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আরও ঘনীভূত হচ্ছে। অন্যদিকে লাগামহীনভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। যে কারণে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা অনুমান করা মুশকিল।

সম্প্রতি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনও বলেছেন, দুর্ভিক্ষ নিয়ে ফাও’য়ের রিপোর্ট আসলে সত্য। কারণ, একদিকে সংকট অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি আবহাওয়া ভিন্নরূপ হিসাবে বন্যা, খরাও বাড়ছে।

এদিকে, দেশে মূল্যস্ফীতির হার লাগামহীনভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ১০ শতাংশের ঘরে। এর আগে যে হার ৫ থেকে ৬ শতাংশের ঘরে ছিল। গত মে থেকে এ হার ৭ শতাংশের ঘরে ওঠে। আগস্টে একলাফে সাড়ে ৯ শতাংশে ওঠে।

এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে মানুষের আয় কমে যাবে। এতে ক্রয়ক্ষমতা কমে দেশের অর্থনীতিতে আরও মন্দা বাড়বে।

যেভাবে এলো দুর্ভিক্ষের আলোচনা

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) আগামী বছর বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কার কথা বলেছে। সেই সঙ্গে সংস্থাদুটি বলেছে, ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। কোথাও কোথাও খাদ্যের তীব্র সংকটও দেখা দিতে পারে। এমন খবরের মধ্যে বাংলাদেশেও আলোচনায় আসে দুর্ভিক্ষের বিষয়টি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছুদিন ধরে একাধিক অনুষ্ঠানে উদ্বেগের সঙ্গে খাদ্য সংকটের কথা বলছেন। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসে দেশে ফিরে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এডিবিসহ দাতাসংস্থাগুলোর পূর্বাভাস তুলে ধরে খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথাও বলেন তিনি।

এর আগে গত সেপ্টেম্বরে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থার যৌথ প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার পেছনে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে খাদ্য সংকটে থাকা মানুষের ৬০ শতাংশের বসবাস যুদ্ধ কবলিত এলাকায় বলে তথ্য উঠে এসেছে। এর বাইরেও জলবায়ুজনিত কারণ, করোনায় বিশ্ব অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না পারা, জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার কথা বলাও হয়েছে প্রতিবেদনে।

দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেটি একেবারে অমূলক নয়। তিনি যে আগে থেকেই উৎপাদন বাড়ানোর যে কথা বলছেন সেটি বাস্তবসম্মত। কারণ, খাদ্যের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে না।

খাদ্য সংকট দেখা দিলেই দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি হওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হয় এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে। কারণ খাদ্যমূল্য বেড়ে গেলে দরিদ্র মানুষ কিনতে পারে না।

রিজার্ভেও ভাটার টান

এদিকে রিজার্ভের অবস্থাও নিম্নমুখী। বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে, যা ২৮ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করার পর রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কার কথা বলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।

Bangladesh Bankবিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের সমাধানে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে তিনি বলেছেন, আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কি হবে।

স্বস্তি আনতে পারে আইএমএফের ঋণ

কয়েকমাস ধরেই দেশে ডলার নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। ফলে ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য। সেই সংকট সামলাতে আইএমএফের কাছে ঋণ চাইছে বাংলাদেশ। গত ২৪ জুলাই প্রায় ৪০০ কোটি ঋণ চেয়ে আইএমএফের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে সরকার।

IMFঅর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরণের ঋণ আমাদের রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখতে একটা ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি ডলার মার্কেটে স্বস্তি তৈরি করতে পারে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ আশাবাদী বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন।

বিষয়টিতে অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ঢাকা মেইলকে বলেন, আইএমএফের ঋণটা পেলে সীমিত আকারে হলেও আমরা অর্থটা ব্যবহারের সুযোগ পাব। একই সঙ্গে রিজার্ভের একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে টাকার বিনিময় হার স্বস্তিতে রাখবে। এতে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে অস্থিরতা কাটবে, সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *